লেখকঃ দীপ্ত হৃদ মতিন (অতিরিক্ত মহাপরিচালক বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড)
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগি শনাক্ত হয় এবং ১৮মার্চ প্রথম একজন মৃত্যুবরণ করেন। কর্তৃপক্ষ সরকারি অফিস ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করেন এবং পর্যায়ক্রমে ছুটি বাড়িয়ে বর্তমানে ৩০মে পর্যন্ত করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সারা দুনিয়ার সব পেশার, সব বয়সের সকল মানুষের স্বাবাভিক জীবনযাত্রা,কর্মধারা স্থবির হয়ে পড়েছে এবং তিন লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন। মৃত্যু আতংকে সারা দুনিয়া দিশেহারা।যে ভাইরাস চোখে দেখা যায়না, এর ভয়ে গোটা পৃথিবীর দরজা আঁটা। মনে হয় সবকিছুতে করোনা ঔতপেতে আছে। জীবনের জন্য যে খাদ্য, এসবেও ভীষণ আতংক। দিবানিশি গৃহবন্দি আছি, আতংকিত থাকি। পৃথিবীর সকল দেশের সরকার,সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের সংক্রণ থেকে মানুষের জীবন রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন এবং করছেন।আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগি পদক্ষেপে, নির্দেশনায়, সার্বিক তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট সকলে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন । জীবনে বেঁচে থাকার নিমিত্ত সরকার নির্দেশিত সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমাদের দুই ছেলে, গৃহিণীসহ আমরা লকডাউনে আছি। তবুও প্রতিটি মুহূর্ত ভীষণ ভীতিকর মৃত্যু আতংকে ভরপুর, অনিশ্চিত জীবনের কোথায় পাই আশার ঠিকানা।
এ সময়,সময়ের দুঃসময়! আজ থেমে গেছে সভ্যতার সকল চাকা,বিকল সব সভ্যতা। চূর্ণ বিচূর্ণ সব আধুনিকতা, পাথরের মতো অসহায় জগতের সব মানুষ। বৈশ্বিক এ মহামারির প্রেক্ষাপটে আমাদের জীবনের সবকিছু গৌণ।আমিও হতে পারি পরিস্থিতির শিকার যার পরিনাম মৃত্যু। আমি মৃত্যু আতংকিত পৃথিবীর এক নগণ্য মানুষ হিসেবে লিখবো, এ সময়ের আমার এক টুকরো জীবনের কথা, যে কথাগুলো আমার সুদীর্ঘ বত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ের চাকুরি জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।আমি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারী কর্মচারি কল্যাণ বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদে কর্মরত আছি। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলা একাডেমীর সচিব হিসেবে কর্তৃপক্ষ আমার বদলির আদেশ জারি করেন। আদেশ দেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টি অবহিত করি। বাংলা একাডেমির সম্মানিত সভাপতি আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান(সদ্যপ্রয়াত) মহোদয় শুনে বলেছিলেন “আমি খুশি হয়েছি”। আমার শিক্ষাগুরু অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার শুনেও খুবই আনন্দ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই বাংলা একাডেমির ফেলো। আমার পদায়নের বিষয়টি যাঁরাই শুনেছেন খুশি হয়ছেন।
আমি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী মহোদয়ের সঙ্গে মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন তাঁর অফিসে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। তিনি অফিসের পরিচালক পর্যায়ের সাত/আটজনকে ডেকে এনে সম্মিলিতভাবে বড় আকৃতির সুদৃশ্য একটি ফুলের তোড়া দিয়ে আমাকে বাংলা একাডেমিতে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং তিণি জানালেন “আপনি এসেছেন, আমি খুশি হয়েছি।এখন একাডেমি আপনারই অফিস”। বাংলা একাডেমিতে আমার যোগদানের বিষয়ে আলাপ হয়েছিলো যে,যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যোগদান করবো। আমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নেই। কবি ও লেখক হিসেবে আমি একাডেমির সদস্য এবং অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত। প্রথমবারের মতো এবার একজন কবি আমলাকে একাডেমির সচিব হিসেবে পোষ্টিং দেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আমার কবিত্বকে হয়তো মূল্যায়ণ করেছেন,বিশ্বাস করি।বৈশ্বিক মহামারির প্রেক্ষাপটে যদিও নগণ্য, আমার ব্যক্তি জীবনের একটি উল্লেখ্য বিষয় হলো আগামী ২০ সেপ্টেম্বর থেকে পিআরএল শুরু। নিরাশায়,অনিশ্চয়তায় ভরপুর আমার চাকরি জীবনের শেষ সময়টুকু। জীবন থেমে নেই,সময়ের প্রবহমাণতা থেমে নেই। জীবনের শেষ সময়গুলো করোনার আতংকে,উৎকন্ঠায় বিভীষিকাময় অন্ধকার গুহার ভেতর দিয়ে যেনো পাড় করছি। জীবনের সব হিসেব একবারে উলটপালট হয়ে গেছে। নতুন কর্মস্থলে যোগদান করা দূরের কথা, আমার পিআরএল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবো কিনা,নাকি চাকুরি থেকে বিদায় গ্রহণের আগেই মৃত্যুর ডাক আসবে ! একমাত্র আল্লাহ জানেন। বড়ো দুর্বিষহ করোনাকাল ও জীবনের ক্রান্তিকাল। একমাত্র ভরসাস্থল, আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। আল্লাহ আপনি রহমতের সূর্য রশ্মি পাঠিয়ে সারা দুনিয়ার যতো করোনা ভাইরাস পুড়িয়ে ছাই করে দিন, আরো বেশি অক্সিজেন পাঠিয়ে করোনা আক্রান্তদের যতো কষ্ট দূর করে দিন। আমরা করোনা আতংকিত প্রহর চাইনা,শান্তিময় গভীর সুনিদ্রা চাই। আল্লাহ আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা।
উৎসর্গঃ আনিসুজ্জামান স্যারের পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে।