শবে বারাত ক্ষমার রাত
লেখক- পীরজাদা মুহাম্মদ এমদাদুল্লাহ শাজলী
মুক্তির পয়গাম, রহমতের বার্তা তাওবার আহ্বান নিয়ে আমাদের মাঝে আবারো ফিরে এসেছে
পবিত্র শবে বারাত। বিশুদ্ধ তাওবা, যিকির-আযকার ও নফল ইবাদাতের জন্য শা’বান মাসের মধ্যবর্তী রাত আমাদের দেশে “শবে বারাত” নামে পরিচিত। শবে বারাত শব্দটিতে ২টি শব্দ যুক্ত হয়েছে। একটি “শব” যার অর্থ রাত। এটি ফার্সী শব্দ। আরবীতে বলে “লাইলাতুন। অন্যটি বারাত যার অর্থ ভাগ্য। একত্রে শবে বারাতের অর্থ দাড়ায় ভাগ্যের রাত। প্রায় ৭০০ বছর যাবত পাক ভারত উপমহাদেশে ফার্সী ভাষা বহুল প্রচলিত ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রটি শবে বারাত নামে পরিচিতি লাভ করে। শাবান আরবী চন্দ্র বছয়ের ৮ম মাসের নাম। পাক-ভারত উপমহাদেশে শাবান মাসের মধ্যরাত “শবে বারাত নামে বহুল পরিচিত হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ রাতের আনুষ্ঠানিকতা বিভিন্ন নামে পালিত হয়ে থাকে। আফ্রিকা অঞ্চলে আচ এর অধিবাসীগণ ইহাকে ফার্সী ভাষায় “কুন্দা ওয়ারীবু’’, প্রাচীন আরবগণ তুগরীর অধিবাসীরা ইহাকে “মাদ্দাগীন” নামে পালন করে থাকে। কুরআন মাজিদের তাফসীরের ভাষায়- লাইলাতুল মুবারাকা, লাইলাতুল-সফ, হাদীসের ভাষায়- লাইলাতুন-নিস্ফী মিন শা’বান নামে নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া শবে বরাতের রাত্রিকে “লাইলাতুর-রাহমাহ, লাইলাতুল বারাকাত, লাইলাতুল-মাগফিরাত, লাইলাতুন নাজাত নামে ও নামকরণ করা হয়েছে। বলা প্রয়োজন শবে বারাত কথাটি এ অধম লেখকের জানা মতে কুরআন মাজিদে নেই। কারণ শবে বারাত ফার্সী ও আরবী মিশ্রিত শব্দ। অন্যদিকে কুরআন নাজিল হয়েছে বিশুদ্ধ আরবীতে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ, বলেন- * ইহা আমি ই-অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কুরআন , যাতে তোমরা বুঝতে পার। (সূরা ইউসুফ : আয়াত-২)
এমনিভাবে আমাদের ইবাদতের মূল এবং, মৌলিক ২টি বিষয় নামাজ এবং রোজা শব্দ ২টিও কুরআন,হাদিসে ব্যবহৃত হয়নি। নামাজ ও রোজা উক্ত ২টি শব্দই ফার্সী। কুরআনে নামাজকে “সালাত এবং রোজাকে সাওম’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আমাদের সমাজে শবে বারাত নামে প্রসিদ্ধ রাতকে হাদীসের ভাষায় বলা হয়েছে “লাইলাতুন নিস্ফী” মিন শা’বান বলে। এই রাতের মর্ম স¤পর্কে রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন-
“আলী ইবনে আবী তালিব (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুল । (সা:) বলেছেন- যখন ১৫ই
শাবানের রাত আসবে তখন তোমরা এ রাতে দাড়িয়ে সালাত আদায় করবে এবং দিনে সিয়াম পালন করবে। কেননা সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর আল্লাহ পৃথিবীর নিকটস্থ আসমানে অবতরণ করেন।
অত:পর তিনি বলেন- আমার কাছে কেউ ক্ষমা প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোন
রিজিক প্রত্যাশী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দিব। কোন রোগগ্রস্থ আছে কি? আমি তাকে শিফা দান করব। এভাবে তিনি বলতে থাকেন, অবশেষে ফজরের সময় হয়ে যায়। (ইবনে মাজাহ হাদীস নং- ১৩৩৮) ।
শবে বারাতের ফজিলত স¤পর্কে রাসুলে দোঁজাহার (সা:) আরো একটি হাদিস পেশ করা হলো- আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- একরাতে আমি নবীকে (সা:) (বিছানায়) না পেয়ে তার খোঁজে বের হলাম। আমি দেখতে পেলাম তিনি জান্নাতুল বাকীতে, তার মাথা আকাশের দিকে উত্তোলন করে আছেন। তখন নবী (সা:) বললেন- হে আয়েশা! তুমি কি এ আশংকা করছ
যে, আল্লাহ এবং রাসুল তোমার উপর অবিচার করবেন? আয়েশা (রাঃ) বলেন- আমি বললাম :
এতো আমার জন্য আদৌ সমীচীন নয়। বরং আমি মনে করেছি, আপনি আপনার অপর কোন বিবির কাছে গেছেন। তখন তিনি (সাঃ) বললেন : মহান আল্লাহ ১৫ শাবান রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী
আকাশে অবতরন করেন এবং কালব গোত্রের বকরীর পশমের চাইতেও অধিক লোককে ক্ষমা
করেন। (ইবনে মাজাহ হাদীসনং- ১৩৮৯)।
সহীহ হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসুল (সা:) নিজেও এ মাসে অধিকাংশ সময় রোজা রাখতেন। রাসূলের সহধর্মিনী আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) রমজান মাসের কাজা রোজা সমূহ পরবর্তী শাবান মাসে রাখতেন। মহানবী (সা:) শাবান মাসে এতো অধিক পরিমানে রাজো রাখতেন যে, অনেক সময় তিনি শা’বানকে রমজানের সাথে মিলিয়ে দিতেন। কিন্তু উম্মতকে শাবান মাসে অধিক সাওম পালন করতে নিষেধ করেছেন। যাতে তারা রমজানের জন্য সতেজ সবল থাকে। অবশ্য রাসুল (সা:) মধ্য শাবানের রাত্রিতে (শবে বারাত) সালাত আদায় করা ও দিনে রোজা রাখার তাগিদ দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর শবে বরাতের স্মৃতি বার্ষিকী স্মরণে বিভিন্ন নামে ও আনুষ্ঠানিকতায় সারা দুনিয়ায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মৃতদের জন্য মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করে, দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করে এবং এ রাত্রিকে ভাগ্যের রজনী হিসেবে ইবাদাত বন্দেগী করে থাকেন।
আসুন শবে বরাতের রাতে দৈনন্দিন ইবাদাতের পাশাপাশি বেশী বেশী নফল ইবাদত, বিশুদ্ধ তাওবা, সালাত আদায়, তাসবীহ তাহলিল, দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ এবং পরদিন রোজা রাখার ইবাদাতকে চালু রেখে আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় ঝাপিয়ে পড়ি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন এবং ক্ষমা করুন আমিন!!
লেখক- পীরজাদা মুহাম্মদ এমদাদুল্লাহ শাজলী
অলিয়ে কামেল মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জাব্বার চিশতি শাজলী (রঃ) এর তৃতীয় সন্তান।